পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকা-যশোরের মধ্যে নতুন ১৭০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের কাজ শেষদিকে। গত বছরের নভেম্বর থেকে আংশিকভাবে ট্রেন চলাচলও শুরু হয়েছে। বর্তমানে চলছে তিনটি আন্তঃনগর ও দুটি মেইল ট্রেন। পণ্যবাহী কোনো ট্রেন চলছে না। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে যাত্রী পরিবহন করে রেলপথটি থেকে আয় হয়েছে প্রায় ৩৭ কোটি টাকা। যদিও রেলপথটি নির্মাণের আগে করা সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, চালুর প্রথম বছর যাত্রী ও পণ্য পরিবহন করে আয় হবে ১ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা। একই সঙ্গে ২০২৪ সালের মধ্যে রেলপথটির বার্ষিক আয় বেড়ে ১ হাজার ৪০২ কোটিতে দাঁড়ানোরও প্রাক্কলনও করা হয়েছিল।
রাজস্ব আয়ের এ প্রাক্কলন করা হয় মূলত পণ্য পরিবহনকে প্রাধান্য দিয়ে। সমীক্ষায় বলা হয়, চালুর প্রথম বছরে পদ্মার নতুন রেলপথ দিয়ে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে প্রতিদিন ১২ জোড়া কনটেইনার ট্রেন চলবে। ২০২৪ সালে শুধু পণ্য পরিবহন করেই রাজস্ব আয় হবে ১ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। কিন্তু রেলপথটি আংশিকভাবে চালুর ১০ মাস পার হলেও কোনো আন্তঃদেশীয় পণ্যবাহী ট্রেন চলেনি। এমনকি স্থানীয় পণ্যবাহী ট্রেনও চলেনি। আরো বলা হয়েছিল, ২০৩০ সালে চালু হবে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, যেখান থেকে প্রতিদিন আরো দুই জোড়ার বেশি ট্রেন (গড়ে ২ দশমিক ৩টি ট্রেন) চলবে। তখন পণ্য পরিবহন বাবদ বছরে আয় বেড়ে দাঁড়াবে ১ হাজার ৮৪৯ কোটি টাকা। যদিও এরই মধ্যে বাতিল হয়েছে পায়রা গভীর সমুদ্র প্রকল্প। বন্দরটি না হওয়ায় ভবিষ্যতে রেলপথটিতে পণ্য পরিবহন বৃদ্ধির সুযোগও সীমিত হয়ে এসেছে।
পদ্মা সেতু সংযোগ রেলপথটি অর্থনৈতিকভাবে কার্যকর করতে হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সমন্বিতভাবে শিল্পায়ন নিশ্চিত করা উচিত ছিল বলে মনে করেন অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু ও পদ্মা সেতু রেল সংযোগ মিলে এ করিডোরে ৮০ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে। বিনিয়োগ করার সময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল—দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্পায়ন হবে, পরিকল্পিত উন্নয়ন করা হবে। পদ্মা সেতু হয়েছে দুই বছর আগে। রেল আংশিক চালুর এক বছর হতে চলল। এখনো এ অঞ্চলে শিল্পায়নের কোনো উদ্যোগ নেই। পদ্মা সেতুর মতো ব্যয়বহুল একটি যোগাযোগ করিডোর অর্থনৈতিকভাবে কার্যকরের জন্য শিল্পায়ন দরকার ছিল। কারণ যাত্রী পরিবহন করে বিনিয়োগ তুলে আনা সম্ভব নয়। একমাত্র পণ্য পরিবহনই পারে রেলপথটির বিনিয়োগ তুলে আনতে।’
তিনি বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে আমি বলব পদ্মা রেল প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য উচ্চাভিলাষী প্রাক্কলন করা হয়েছে। পণ্য পরিবহনকে গুরুত্ব দিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা উচিত ছিল। শুরুতেই সমন্বিত পরিকল্পনা করা জরুরি ছিল। যে পায়রা বন্দরের পণ্য এ রেলপথের মাধ্যমে পরিবহন করার পরিকল্পনা হয়েছিল, সেই বন্দরটিই আদতে বাস্তবায়ন হবে কিনা, তা আগেই যাচাই করা দরকার ছিল। রেলপথটির কাজ শুরুর পর পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প বাদ পড়েছে। ফলে প্রকল্পটি রেলের আয় বাড়ানোর বদলে উল্টো লোকসানি হয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এর সঙ্গে প্রকল্পের জন্য গ্রহণ করা বিদেশী ঋণ দেশের অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি করবে।’
২০২৩ সালের ১ নভেম্বর থেকে আংশিকভাবে পদ্মা সেতু সংযোগ রেলপথ দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। বর্তমানে তিনটি আন্তঃনগর ও দুটি মেইল ট্রেন চলছে। রেলওয়ের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত তিন আন্তঃনগর ট্রেন থেকে রাজস্ব আয় হয়েছে ৩৬ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এর মধ্যে সুন্দরবন এক্সপ্রেস থেকে ১৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা, মধুমতি এক্সপ্রেস থেকে ১০ কোটি ৯৬ লাখ ও বেনাপোল এক্সপ্রেস থেকে ১১ কোটি ১৪ লাখ টাকা আয় হয়েছে। দুটি মেইল ট্রেন থেকে আয়ের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। পদ্মা সেতু দিয়ে চলাচল করা তিনটি আন্তঃনগর ট্রেনই আগে অন্য রুটে চলাচল করত। ফলে এসব ট্রেনের আয় রেলওয়ের সামগ্রিক আয় বাড়াতে কোনো ভূমিকা রাখতে সক্ষম নয়। যদিও পদ্মা রেল প্রকল্পের সমীক্ষায় যাত্রীবাহী ট্রেন পরিচালনা করে বছরে ৫৫ কোটির বেশি টাকা আয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছিল।
পদ্মা সেতু ও মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের কারণে ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে উন্নত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। একই গতিপথে ট্রেন পরিচালনা কতটা লাভজনক হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের আশঙ্কা, রেলপথটি ‘আন্ডার ইউটিলাইজ’ থাকতে পারে। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ার পর পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে তৈরি করা রেলপথ ‘আন্ডার ইউটিলাইজড’ থাকার একটা সম্ভাবনা আছে। অর্থাৎ রেলপথটি খুব বেশি ব্যবহৃত হবে না। তাই বলা যায়, খরচের বিবেচনায় রেলপথটি খুব বেশি লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা নেই। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হবে ২০২৫ সাল থেকে। প্রতি বছর ঋণের কিস্তি যা আসবে, তা রেলপথের আয় দিয়ে মেটানো যাবে না। সেজন্য এ প্রকল্পের ঋণ শোধের বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য বোঝা হিসেবে চেপে থাকবে। বিশেষ করে প্রথম কয়েক বছর প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ নিয়ে বাড়তি চাপে থাকবে বাংলাদেশ।’
দেশের যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গৃহীত সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মা সেতু রেল সংযোগ। নির্মাণ ব্যয় ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য চীন থেকে ২৬৭ কোটি ডলার ঋণ নেয়া হয়েছে। প্রিফারেন্সিয়াল বায়ার্স ক্রেডিটের (পিবিসি) মাধ্যমে নেয়া এ ঋণের সুদহার ২ শতাংশ। গ্রেস পিরিয়ড ছয় বছর। রিপেমেন্ট পিরিয়ড ২০ বছর। ২০২৫ সাল থেকে পদ্মা রেল সংযোগ নির্মাণের জন্য নেয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে। সুদসহ প্রতি বছর গড়ে সাড়ে ১৩ কোটি ডলার বা প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে।
যদিও রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে এ রেলপথ। ঢাকা-খুলনা-যশোরের মধ্যে যাতায়াতের সময় কমে আসবে। সময় কম লাগবে ঢাকা-কলকাতা রেলপথেও। ভবিষ্যতে ঢাকা-গোপালগঞ্জ-টুঙ্গিপাড়া, ঢাকা-ফরিদপুর-রাজবাড়ী এবং ঢাকা-মাগুরার মধ্যে ট্রেন পরিচালনার সুযোগ তৈরি হবে। মোংলা বন্দর, বরিশালসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এ রেলপথ।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।