আরও একবার গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনাকে ব্যাহত করার জন্য ইসরাইলের যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। দেশটির পাবলিক ব্রডকাস্টার কান মঙ্গলবার আলোচনাকারী দলের সূত্রের বরাত দিয়ে এ অভিযোগের কথা জানিয়েছে।
ইসরাইলি গণমাধ্যমটি বলেছে, অভিযোগটি গাজায় ইসরাইলি জিম্মিদের পরিবারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নেতানিয়াহুর সাম্প্রতিক বৈঠক সম্পর্কে মিডিয়ায় যে তথ্য ফাঁস হয়েছে, তার সঙ্গে মিলে যায়। নেতানিয়াহু সে সময় স্বীকার করেছিলেন যে, তিনি ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছানোর বিষয়ে অনিশ্চিত ছিলেন।
ইসরাইলের আলোচনাকারী দলের সূত্রের বরাত দিয়ে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ‘নেতানিয়াহুর সাম্প্রতিক বিবৃতিগুলোর লক্ষ্য ছিল আলোচনাকে নাশকতা করা’।
কান জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সচেতন যে ইসরাইলিরা একটি সংকটময় সময়ের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। কারণ ইসরাইলি বাহিনী ফিলাডেলফি করিডোর এবং নেটজারিম প্যাসেজের সমাধান খুঁজতে কাজ করছে। ইসরাইলি সরকার এ বিষয়টিকে পরবর্তী বৈঠকের আগে উপস্থাপন করবে বলেও ঠিক করেছে। যেটি মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে কায়রোতে অনুষ্ঠিত হবে। যদিও এ বৈঠকের তারিখ এখনও নির্ধারণ করা হয়নি।
ইসরাইলি গণমাধ্যমটি আরও জানিয়েছে, তবে নেতানিয়াহু এমন সব বিবৃতি দিচ্ছেন, যা মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে একমত হওয়া বিষয়গুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
গাজায় বন্দি ইসরাইলিদের পরিবারের সঙ্গে বৈঠকের সময় দেশটির সংবাদমাধ্যম মারিভ জানায়, নেতানিয়াহু বলেছেন- ইসরাইল কোনো অবস্থাতেই এমনকি প্রচণ্ড চাপের মধ্যেও ফিলাডেলফি করিডোর এবং নেটজারিম প্যাসেজের দখল ছাড়বে না।
গাজায় ইসরাইলের আগ্রাসন শুরুর পর থেকে যুদ্ধবিরতি নিয়ে একাধিক প্রস্তাব উঠেছে। কাতার, তুরস্ক, মিসরসহ যুক্তরাষ্ট্রও যুদ্ধবিরতির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গাজায় প্রথম যুদ্ধবিরতির আলোচনা শুরু হয় গত বছরের ২২ নভেম্বর। সে সময় চার দিনের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ওঠে। ১৫০ জন বন্দি ফিলিস্তিনির বদলে ৫০ জন ইসরাইলি বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হবে। পাশাপাশি গাজায় মানবিক সহায়তাও দেওয়া হবে।
যদিও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতির এ প্রস্তাব সাময়িকভাবে মেনে নেন। তবে যুদ্ধ বন্ধে অস্বীকৃতি জানান তিনি। চার দির পর দখলদার ইসরাইল আবার পূর্ণমাত্রার গাজায় আক্রমণ শুরু করে। এরপর যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় আলোচনা হয় গত বছর ডিসেম্বরের ২ তারিখ।
হামাস জানায়, যুদ্ধবিরতি নিয়ে পরবর্তী আলোচনা ভেস্তে যাচ্ছে। কেননা হামাস চাইছিল ইসরাইলের আগ্রাসন পুরোপুরি বন্ধ হোক এবং সব ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হোক। কিন্তু এতেও ইসরাইল অস্বীকৃতি জানায়।
তৃতীয় যুদ্ধবিরতির আলোচনা কার্যকর হয়নি ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের কারণেই। ডিসেম্বরের ১০ তারিখে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ (ইউএনএসসি) যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাবে ভেটো দেয় ওয়াশিংটন। এরপর মিসর, কাতার এবং যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ৩ ধাপে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয় হামাস। সেখানে স্থায়ীভাবে যুদ্ধ বন্ধ, ইসরাইলি বন্দিদের মুক্তি, গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশসহ আরও কিছু প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু নেতানিয়াহু সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখে চলে চতুর্থ যুদ্ধবিরতির আলোচনা। এ সময়ও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবকে নাকোচ করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। নেতানিয়াহুও যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানান। অবশেষে মার্চের ২৬ তারিখ পঞ্চমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র ইউএনএসসি’র যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে। কিন্তু ইসরাইলকে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সমর্থনও জানায় তারা।
এরপর মে মাসের ৭ তারিখ মিসরও কাতারের মধ্যস্থতায় আবারও একটি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আসে। সেই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল- ধীরে ধীরে গাজা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করবে ইসরাইল। পাশাপাশি গাজা পুনর্গঠনেও সাহায্য করবে। কিন্তু ইসরাইল কখনোই পুরোপুরি যুদ্ধবিরতি চায়নি। এ প্রস্তাবের পরই রাফাহ আক্রমণ শুরু করে ইসরাইল।
৩১ জুলাই ইরানে হামাসপ্রধান ইসমাইল হানিয়ার মৃত্যুতে আবারও থমকে যায় যুদ্ধবিরতির সপ্তমবারের আলোচনা। এরপর শেষমেশ অষ্টমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতির আলোচনা চূড়ান্ত না করতে পাঁচটি কঠিন শর্ত দেন। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- হামাসের সীমান্ত অতিক্রম প্রতিরোধ, রাফাহ সীমান্তের ওপর ইসরাইলি নিয়ন্ত্রণ, ইসরাইলি বন্দিদের তথ্য ফাঁস এবং ফিলিস্তিনি বন্দিদের নির্বাসন। ইসরাইলের এসব শর্ত ছিল যুদ্ধবিরতির অন্তরায়।
সোমবার যুদ্ধবিরতির আলোচনাকে সামনে রেখে আবারও ইসরাইল সফরে আসেন ব্লিঙ্কেন। ব্লিঙ্কেন বলেছেন, ‘৭ অক্টোবর থেকে ইসরাইলে, মধ্যপ্রাচ্যে এটি আমার নবম সফর। এটি একটি চূড়ান্ত মুহূর্ত। জিম্মিদের বাড়ি ফেরানোর, যুদ্ধবিরতি চুক্তি করার এবং সবাইকে স্থায়ী শান্তি ও নিরাপত্তার দিকে নিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত ও শেষ সুযোগ।’
তবে হামাস এ চুক্তির অগ্রগতি ‘ভ্রম’ বলে মন্তব্য করেছে। কারণ গাজা থেকে ইসরাইলি সেনাদের সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার হবে কি-না, সে বিষয়ে এখনো মতপার্থক্য রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে হামাস।
গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় ইসরাইল তার নৃশংস হামলা অব্যাহত রেখেছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো সত্ত্বেও।
স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের মতে, ইসরাইলি আগ্রাসনে এ পর্যন্ত ৪০ হাজার ১৭০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। যাদের বেশিরভাগই নারী এবং শিশু। এছাড়া আহত হয়েছেন ৯২ হাজার ৭৪০ জনেরও বেশি। তথ্য সূত্র: ডেইলি সাবাহ ও আল-জাজিরা