বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরুটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে হলেও টার্নিং পয়েন্টে হাল ধরেছিলেন মূলত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গত ১৫ জুলাই বিভিন্ন ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ওপর একের পর এক হামলা হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সম্মিলিতভাবে আন্দোলনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দেন। পরদিনই নেমে পড়েন রাস্তায়। এর মধ্যে ১৭ জুলাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগে বাধ্য করা হলে স্তিমিত হয়ে পড়ে আন্দোলন। ঠিক সে মুহূর্তে শক্ত অবস্থান নিয়ে রাজপথ আঁকড়ে থাকেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, যুক্ত করেন নতুন মাত্রা। পুলিশ ১৮ জুলাই নির্বিচারে গুলি চালালে নিহত হন তিন শিক্ষার্থী, যা এ আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। স্ফুলিঙ্গের মতো বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সব ক্যাম্পাসে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭ শিক্ষার্থী নিহতের খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে বণিক বার্তার অনুসন্ধানে। সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকার ১২টি ও রাজশাহীর একটিসহ মোট ১৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ১৮ জুলাই থেকে ১০ আগস্টের মধ্যে প্রাণ হারান। এর মধ্যে নয়জনই গুলিবিদ্ধ হন সরকার পতনের দিন অর্থাৎ ৫ আগস্ট। বাকিরা ১৮-২১ জুলাইয়ের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হন। তাদের মধ্যে কয়েকজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিভিন্ন সময় মারা গেছেন।
আন্দোলনে নেমে ১৮ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী পারভেজ শাকিল, মো. ইরফান ভূইয়া ও আসিফ হাসান। এর মধ্যে শাকিল মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিবিএ, ইরফান ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ও আসিফ নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। ওইদিন রামপুরায় গুলিবিদ্ধ হন বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজির অ্যাপারেল মার্চেন্ডাইজিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী মো. সেলিম তালুকদার। চিকিৎসাধীন আবস্থায় তিনি ১ আগস্ট মারা যান। তার গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলায়।
ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের সাবেক শিক্ষার্থী আসিফ ইকবাল গত ১৯ জুলাই নিহত হন। ওইদিন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির বিবিএর শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ আহমেদ জাবির। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৬ জুলাই মারা যান তিনি। যাত্রাবাড়ীতে নিজ বাসার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির ইইই বিভাগের শিক্ষার্থী রাব্বী মিয়া বাইরে থেকে আসা গুলিতে ২০ জুলাই প্রাণ হারান।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি নিহত হন ৫ আগস্ট। সরকার পতনের ওইদিন মোট নয় শিক্ষার্থী প্রাণ হারান। সংঘর্ষে নিহত হন সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দুই শিক্ষার্থী রাকিব হোসেন ও রবিউল ইসলাম। এর মধ্যে রাকিব বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার রহমতপুর ইউনিয়নের আলমগীর হোসেন হাওলাদারের ছেলে। রবিউলের বাবার নাম মোল্লা আহমেদ সাঈদ। গ্রামের বাড়ি খুলনার ডুমুরিয়ায়।
আশুলিয়ার বাইপাইলে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইইই বিভাগের শিক্ষার্থী মো. আহনাফ আবির আশরাফুল্লাহ। তার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার বারোপাখিয়া গ্রামে। সাভারে নিহত হন সিটি ইউনিভার্সিটির টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সাজ্জাদ হোসেন সজল। যাত্রাবাড়ীতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটির বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী রাসেল মাহমুদ। সরকার পতনের পর লালমনিরহাটে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের বাসা থেকে ছয়জনের দগ্ধ মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে একজন ছিলেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আল-আফরোজ শ্রাবণ। রাজশাহীতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থী সাকিব আনজুম।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন গুলিবিদ্ধ হন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির দুই শিক্ষার্থী। মিরপুর ২ নম্বরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ইইই বিভাগের শিক্ষার্থী সুজন মাহমুদ। একই দিন গুলিবিদ্ধ হন সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থী তাহমিদ আবদুল্লাহ অয়ন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ আগস্ট তার মৃত্যু হয়।
গত ১৮ জুলাই নিহত হন ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী মো. ইরফান ভূইয়া। তার গ্রামের বাড়ি নরসিংদী সদরের কান্দাইলে। তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলেসন্তান। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে ইরফানের বাবা আমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ‘নিহত হওয়ার দিন আন্দোলনে অংশ নিতে বাড্ডায় যাওয়ার কথা শুনেছি। কিন্তু পেটে সমস্যা হওয়ায় সকাল থেকেই অসুস্থ ছিল সে। তাই আর বাড্ডায় যায়নি। বেলা ১টার দিকে শনিরআখড়ায় যায়। বিকাল ৫টার দিকে আমার কাছে ছেলের মৃত্যুর খবর আসে। ডান পাঁজরের পেছন দিক দিয়ে গুলি ডুকে বেরিয়ে গেছে। হাতের আঙুলগুলো ভাঙা মনে হয়েছে। মাথায়ও আঘাত ছিল। মনে হচ্ছে আমার ছেলেকে বেধড়ক মারার পর উপুড় করে মাটিতে ফেলে পেছন থেকে গুলি করা হয়েছে।’
নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আসিফ হাসানও ১৮ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তার গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার দেবহাটায়। কৃষক বাবার বড় তিন বোন ও যমজ দুই ভাইয়ের একজন ছিলেন আসিফ।
নিহতের ভাই সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী রাকিব হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘উত্তরার বিএনএস সেন্টারের ওখানে ১৮ জুলাই দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ১টার মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয় আসিফ। ছররা গুলিতে বুকটা ঝাঁজরা ছিল। শতাধিক ছররা গুলি লাগে বুকে। বগলের নিচের দিকে একটা গুলি লাগছে।’ রাকিব হাসান হোয়াটসঅ্যাপে নিহত ভাইয়ের কয়েকটি ছবি পাঠিয়ে এর সত্যতাও নিশ্চিত করেন।
১৮ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারানো মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিবিএর শিক্ষার্থী পারভেজ শাকিলের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর সদরের চাপিলাতলী। শাকিল ছিলেন বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলেসন্তান। বড় তিন বোনের সবাই বিবাহিত। টঙ্গীতে মাটির হাঁড়ি-পাতিলের ছোট ব্যবসা রয়েছে বাবার।
শাকিলের বাবা বেলায়েত হোসেন জানান, ১৮ জুলাই সকাল সাড়ে ৭টায় বাসা থেকে বের হয়ে যান শাকিল। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে উত্তরার বিএনএস সেন্টারের সামনে গুলিবিদ্ধ হন। মুখে ছররা গুলি আর বুকে বুলেটবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের শিক্ষার্থী আসিফ ইকবাল নিহত হন গত ১৯ জুলাই। মিরপুর ১০ নম্বরে ছাত্র-জনতার ওপর করা পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনি। আসিফের বাসা পল্লবী মডেল স্কুলের গলির শেষ মাথায় ৭ নম্বর রোডের ২৮ নম্বরে। বাবার নাম আব্দুর রাজ্জাক। গ্রামের বাড়ি মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার নওহাটায়।
ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভের (ইউডা) চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী মো. শাকিল হোসেন জুলফিকার ৪ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হন। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭ আগস্ট তিনি মারা যান। শাকিলের গ্রামের বাড়ি ভোলা সদরের নয়াচর।
ঘটনার দিন মিরপুর ১০ গোল চত্বরে বেলা ১টার দিকে শাকিল মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। তার মা বিবি আয়েশা বলেন, ‘ওইদিন দুপুর ১২টার দিকে বসায় আসে শাকিল। খাবার খেয়ে আবার সাড়ে ১২টার দিকে বেরিয়ে যায়। বিকালে কয়েকজন ছাত্রী এসে বলে, আন্টি শাকিল একটু অসুস্থ, কুর্মিটলা হাসপাতালে নেয়া হইছে। আপনি না গেলে ডাক্তার চিকিৎসা করবে না। এরপর একটা সিএনজি নিয়ে বের হলে পথে অনেক বাধার মুখে পড়ি। ওখানে যাওয়ার আগেই শুনি নিউরোসায়েন্সে নেয়া হচ্ছে। সেখানে গিয়া দেখি আমার বাবার কোনো সাড়াশব্দ নাই। মাথায় ব্যান্ডেজ করা। এ অবস্থায় হাসপাতালে ছিল। ৭ আগস্ট ডাক্তার মৃত ঘোষণা করে।’
জানা গেছে, ২০১৪ সালে শাকিলের বাবা সিদ্দিক মৃধা মারা গেলে বড় দুই বোন, শাকিল আর ছোট আরেক ভাইকে নিয়ে জীবিকার সন্ধানে ঢাকায় আসেন শাকিলের মা বিবি আয়েশা। মানুষের বাসাবাড়িতে কাজ করে সংসার চালান তিনি। শাকিল নিজেও টিউশনি করে নিজের খরচ বহন করতেন। ছোট ভাই একটি পাঞ্জাবির কারখানায় কাজ করেন।
গুলিবিদ্ধ হয়ে ৫ আগস্ট নিহত হন সিটি ইউনিভার্সিটির ইইই বিভাগের শিক্ষার্থী মো. আহনাফ আবির আশরাফুল্লাহ। তার বোন আইনজীবী সৈয়দা আক্তার বণিক বার্তাকে জানান, তারা তিন বোন, এক ভাই। আশুলিয়ার বাইপাইলে গুলিবিদ্ধ হন। দুপুরে হাতে একটা গুলি লাগে, সেটা ফেসবুকেও পোস্ট করেছিল। এরপর ওইদিন সন্ধ্যা ৬টায় মৃত্যুর খবর পাওয়ার আগ পর্যন্ত সর্বশেষ সোয়া ৪টায় কথা হয়। যখন ভাইকে দেখেন তার নাক জখম ছিল। বুকের ডান পাশে যেখানে গুলি লাগে সেটা খুলে দেখারও সাহস পাননি তিনি।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি) ইইই বিভাগের শিক্ষার্থী সুজন মাহমুদ মিথি ৫ আগস্ট মিরপুর ২ নম্বরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। একই দিন সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থী মো. তাহমিদ আব্দুল্লাহ গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ আগস্ট মারা যান। বিইউবিটির দুটি ভবন বর্তমানে নিহত এ দুই শিক্ষার্থীর নামে নামকরণ করা হয়েছে।