ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ৩০ দিন আগে হেলিকপ্টারে চড়ে বাংলাদেশ থেকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পালিয়ে যান প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতে তার এই অবস্থানকে স্বাভাবিক চোখে দেখছে না বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকার। স্বাভাবিকভাবে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা ফাটল দেখা দিয়েছে। ফলে শেখ হাসিনা হয়ে উঠেছেন দিল্লির কূটনৈতিক মাথা ব্যথার কারণ।
১৫ বছর ধরে অধিকার লঙ্ঘন এবং বিরোধীদের দমন-পীড়নের কারণে গত মাসে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবন অভিমুখে যখন বিক্ষোভকারীরা মিছিল নিয়ে যাচ্ছিল তখনই হাসিনার লৌহশাসনের মেয়াদ শেষ হয়।
বিদ্রোহের নেতৃত্ব দানকারী বাংলাদেশি ছাত্ররা বিক্ষোভকারীদের হত্যার বিচারের জন্য শেখ হাসিনার প্রত্যাবাসন দাবি করছে। কিন্তু ৭৬ বছর বয়সীকে হাসিনাকে ফেরত পাঠানো হলে দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যান্য প্রতিবেশীদের সাথে ভারতের অবস্থানকে ক্ষুণ্ন হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। কারণ চীনের আঞ্চলিক প্রভাবের ঠেকানো জন্য একটি ভয়ঙ্কর যুদ্ধ চালাচ্ছে দিল্লি।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের টমাস কিন বলেন, ভারত স্পষ্টতই তাকে বাংলাদেশে ফেরত দিতে চায় না। কারণ এতে এই অঞ্চলে নয়াদিল্লির ঘনিষ্ঠ নেতাদের কাছে যে বার্তাটি যাবে তা খুব ইতিবাচক হবে না… শেষ পর্যন্ত ভারত আপনাকে রক্ষা করবে না।
নয়াদিল্লি গত বছর মালদ্বীপে তার পছন্দের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে হেরে যেতে দেখেছে। এর ফলে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিলাসবহুল পর্যটন গন্তব্যের দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট বেইজিংয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন।
হাসিনার পতনের ফলে এই অঞ্চলে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্রকে হারিয়েছে ভারত।
বাংলাদেশে যারা হাসিনা সরকারের নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তারা ভারতের প্রতি প্রকাশ্য শত্রুতা রয়েছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মেগাফোন কূটনীতির মাধ্যমে সেই শত্রুতার আগুন ধীরে ধীরে নিভর্পিত হয়েছে এবং সেই কূটনীতি বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসনের দিকে পরিচালিত হয়েছে।
৮৪ বছর বয়সী নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মুহম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মোদি। হিন্দু বিশ্বাসকে তার মেয়াদের মূল স্তম্ভ বানানো মোদি বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার জন্য ইউনূসের প্রশাসনকে বারবার অনুরোধ করেছেন।
হাসিনার আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ে বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের বেশি সুরক্ষা প্রদানকারী বলে মনে করা হয়।
১৭ শতকের লাল কেল্লার উপরে দাঁড়িয়ে বার্ষিক স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে মোদি বলেছিলেন বাংলাদেশের হিন্দুরা বিপদে আছে এবং পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন।
শেখ হাসিনার প্রস্থানের পর কিছু বাংলাদেশি হিন্দু ও হিন্দু মন্দিরের ওপর হামলা হয়েছিল। ছাত্র নেতারা এবং অন্তর্বর্তী সরকার এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছিল।
কিন্তু সহিংসতার চরম অতিরঞ্জিত বিবরণ দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেছিল সরকার সমর্থক ভারতীয় নিউজ চ্যানেলগুলো। এসব সংবাদের কারণে মোদির দলের সাথে যুক্ত হিন্দু গোষ্ঠীগুলো বিক্ষোভ করেছিল।
বিএনপির শীর্ষ নেতা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ভারত হাসিনাকে সমর্থন করে ‘তার সব ফল এক ঝুড়িতে রেখেছিল’ এবং এটি কীভাবে উল্টাতে হবে তা জানে না।
হাসিনার আমলে গ্রেপ্তার হওয়া হাজার হাজার বিএনপি নেতাকর্মীদের একজন আলমগীর এএফপিকে বলেন, বাংলাদেশের জনগণ ভারতের সাথে ভালো সম্পর্ক চায়, কিন্তু তাদের স্বার্থের মূল্যে নয়। দুর্ভাগ্যবশত ভারতের মনোভাব আত্মবিশ্বাস তৈরির জন্য অনুকূল নয়।
এইরকমই অবিশ্বাসের পরিবেশে অগাস্ট মাসে মারাত্মক বন্যা উভয় দেশে ভেসে যায়। কিছু বাংলাদেশি বন্যায় মৃত্যুর জন্য ভারতকে দায়ী করে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার প্রকাশ্যে নয়াদিল্লির কাছে হাসিনার ভারতে আশ্রয় নেওয়ার বিষয়টি উত্থাপন করেনি। হাসিনার সর্বশেষ সরকারি অবস্থান রাজধানীর কাছে একটি সামরিক বিমানঘাঁটিতে। কিন্তু ঢাকা তার কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিল করেছে, তার অন্যদেশে যাওয়া ঠেকিয়ে দিয়েছে।
২০১৩ সালে দুই দেশের মধ্যে প্রত্যর্পণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং এই চুক্তি হাসিনাকে ফৌজদারি বিচারের মুখোমুখি করার অনুমতি দেবে। তবে চুক্তির একটি ধারা অনুযায়ী অপরাধটি ‘রাজনৈতিক চরিত্রের’ হলে প্রত্যর্পণ প্রত্যাখ্যান করা যেতে পারে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেছেন, হাসিনাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়ার বিষয়টি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ঢাকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি এএফপিকে বলেন, যে কোনো পরিণত সরকার বুঝতে পারবে যে হাসিনার ভারতে থাকার বিষয়টিকে ইস্যু করা তাদের কোনো সুবিধা দেবে না।