“এই রাজনীতি অবশ্যই ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ, সেশনজট, র্যাগিং-বুলিং, দখল-বাণিজ্য, হত্যা-সন্ত্রাসের ছাত্র রাজনীতি নয়,” বলেন সাদ্দাম হোসেন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীদের নিয়ে এ শিক্ষায়তনে ‘স্মার্ট ও নিয়মতান্ত্রিক’ ছাত্র রাজনীতি চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন।
তিনি বলেছেন, “আমরা বুয়েট শিক্ষার্থীদের মতামত নেব। তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে একটি নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতির প্রস্তাবনা উল্লেখ করে আমরা আমাদের সাংগঠনিক কার্যক্রমে যাব।”
উচ্চ আদালতের আদেশে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি ফেরার পথ খোলার পর মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করে এই প্রতিশ্রুতি দেন ছাত্রলীগ সভাপতি।
তিনি বলেন, “প্রথাগত ছাত্র রাজনীতির মত কেন্দ্র থেকে চাপিয়ে দেওয়া নেতৃত্বের মাধ্যমে বুয়েট শিক্ষার্থীরা পরিচালিত হবে না। বুয়েটের শিক্ষার্থীরা নিজেরাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের নেতৃত্ব নির্বাচন করবে। যে নেতৃত্ব হবে আদর্শিক, দেশাত্মবোধসম্পন্ন এবং যে নেতৃত্ব বুয়েটের শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকেই তৈরি করবে বিশ্বসেরা উদ্ভাবক, উদ্যোক্তা।”
সাড়ে চার বছর আগে ছাত্রলীগ নেতাদের নির্যাতনে এক ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনায় শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়। হাই কোর্ট সোমবার সেই নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করে দিলেও বুয়েট শিক্ষার্থীরা ‘রাজনীতিমুক্ত’ ক্যাম্পাসের দাবিতে অটল থাকার কথা বলেছে।
তাদের আশ্বস্ত করে সাদ্দাম বলেন, “বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি পুনরায় শুরু হবে। কিন্তু সেটি কোন ছাত্র রাজনীতি তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। এই রাজনীতি অবশ্যই ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ, সেশনজট, র্যাগিং-বুলিং, দখল-বাণিজ্য, হত্যা-সন্ত্রাসের ছাত্র রাজনীতি নয়। এই ছাত্র রাজনীতি হবে আধুনিক, যুগোপযোগী, বৈচিত্র্যময়-সৃষ্টিশীল, জ্ঞান-যুক্তি-তথ্য-তত্ত্বনির্ভর।”
ছাত্রলীগ সভাপতি বলছেন, বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি ফিরিয়ে এনেই ছাত্রলীগ দায়িত্ব শেষ করবে না। বুয়েট হবে ছাত্র রাজনীতির ‘মডেল’।
“দেশরত্ন শেখ হাসিনার পরিকল্পিত আগামী দিনের উন্নত, স্মার্ট বাংলাদেশে উন্নত ও স্মার্ট ছাত্র রাজনীতি উপহার দেওয়ার জন্য মডেল প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বুয়েটকে গ্রহণ করবে। এই ঐতিহাসিক যাত্রায় বুয়েটের সকল শিক্ষার্থীকে সহযোগিতার সংকল্প নিয়ে পাশে থাকার আহ্বান জানাচ্ছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
“একইসাথে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ প্রগতিশীল সকল ছাত্র সংগঠনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে, আসুন গৎবাঁধা ধারা বাদ দিয়ে আধুনিক, উন্নত ছাত্র রাজনীতির চর্চা শুরু করুন বুয়েট থেকেই। সুন্দর, স্বনির্ভর, সম্মানজনক ভবিষ্যৎ গড়তে আজকের প্রজন্ম আর কালক্ষেপণ করবে না, এটিই বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আহ্বান।”
কেন ছাত্র রাজনীতির বিরোধিতা
বুয়েটের শেরেবাংলা হলের আবাসিক ছাত্র আবরারকে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে ছাত্রলীগের এক নেতার কক্ষে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। সেই ঘটনায় ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে বুয়েট। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বুয়েটে নিষিদ্ধ হয় ছাত্র রাজনীতি।
এরপর থেকে গত সাড়ে চার বছর প্রকৌশল শিক্ষার এই বিদ্যাপীঠে ছাত্র সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধই ছিল। এর মধ্যেই গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতিসহ একদল নেতাকর্মী বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলে নতুন করে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা।
তাদের ভাষ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিমালা লঙ্ঘন করে পুরকৌশল বিভাগের ২১তম ব্যাচের ছাত্র ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইমতিয়াজ হোসেন রাহিম এ সমাগম ঘটান।
এ ঘটনায় শুক্রবার বিকালে বুয়েটের শহীদ মিনারের সামনে শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন করেন। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালকের (ডিএসডব্লিউ) কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিক্ষোভ দেখান। পরে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেন।
এরপর রাতে বুয়েটের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ফোরকান উদ্দিন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে ইমতিয়াজ হোসেন রাহিমের হলের সিট বাতিল করা হয়। পাশাপাশি বিষয়টি তদন্তে কমিটি গঠন করে ৮ এপ্রিলের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়।
এর মধ্যে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি ফেরানোর দাবিতে পাল্টা কর্মসূচি দেয় ছাত্রলীগ। রোববার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করে তারা অবিলম্বে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি চালুর অনুমতি দেওয়ার দাবি জানায়। পরে বুয়েট ক্যাম্পাসে গিয়ে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ছাত্রলীগের কয়েকশ নেতাকর্মী।
এদিকে ছাত্র রাজনীতিতে নিষেধাজ্ঞার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সোমবার হাই কোর্টে রিট মামলা করেন হল থেকে বহিষ্কৃত ইমতিয়াজ হোসেন রাহিম রাব্বী। তার আবেদনের শুনানি করেই বুয়েটের নিষেধাজ্ঞার আদেশ স্থগিত করার পাশাপাশি রুল জারি করে বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ারের বেঞ্চ।
এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বুয়েটের উপাচার্য অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদার বলেন, “কোর্ট যেটা বলবে আমাদের সেটা মানতে হবে। কোর্টের আদেশ শিরোধার্য। আদালত অবমাননা আমরা করতে পারব না।”
তবে শিক্ষার্থীরা নিজেদের প্রত্যাশার জায়গায় অনড় থাকার কথা জানিয়ে হাই কোর্টের ওই আদেশের বিপক্ষে আইনি লড়াই চালাতে উপাচার্যের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
সোমবার বিকালে শিক্ষার্থীদের এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, “আমরা বুয়েট প্রশাসনের কাছে দাবি রাখব, এ বিষয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতামত বিচার বিভাগে যথাযথভাবে তুলে ধরা হোক। ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি না থাকার যে দাবি, তার যৌক্তিকতা নিয়ে আমরা ঐক্যবদ্ধ এবং অটল।
“যে ছাত্র রাজনীতি র্যাগিং কালচারকে প্রশ্রয় দেয়, ক্ষমতার অপব্যবহারের পথ খুলে দেয়, যার বলি হতে হয় নিরীহ ছাত্রদেরকে, তা আমাদের জন্য ভালো কিছু কখনোই বয়ে আনেনি, আনবেও না। এর চরমতম মূল্য হিসেবে আমরা আমাদের কেমিকৌশল ৯৯ এর সাবেকুন্নাহার সনি আপু, যন্ত্রকৌশল ০৯ এর আরিফ রায়হান দ্বীপ ভাই এবং সর্বশেষ তড়িৎকৌশল ১৭ এর আবরার ফাহাদ ভাইকে হারিয়েছি।”
উপাচার্যের উদ্দেশে তাদের আহ্বান: “আমাদের মাননীয় ভিসি স্যারকে এই আর্জি জানাচ্ছি, তিনি যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষককে নিয়ে আপামর বুয়েট শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ছাত্ররাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসের যে আকাঙ্ক্ষা, তা সকল আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যাতে পূরণ করেন।”
কী করবে ছাত্রলীগ?
ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ‘স্মার্ট ও পলিসি নির্ভর নিয়মতান্ত্রিক’ ছাত্র রাজনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মধুর ক্যান্টিনের সংবাদ সম্মেলন থেকে বেশ কিছু কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে নির্দিষ্ট কোনো তারিখ ঘোষণা করেননি সাদ্দাম। ‘সুবিধামত’ সময়ে তা বাস্তবায়ন করা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
সাদ্দাম বলেন, “তারিখগুলো আমরা পরবর্তী সময়ে জানিয়ে দেব। যেহেতু বুয়েটে পরীক্ষা চলছে। তাদের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়- এ ধরনের কর্মসূচি ছাত্রলীগ গ্রহণ করবে না। কর্মসূচি এমন সময় পালন করব, যাতে বুয়েটের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম নির্বিঘ্নে চালু থাকে।
“আমরা কোনো ধরনের তাড়াহুড়োর মধ্যে নেই। সাংগঠনিক কমিটি গঠন যতটা না আমাদের লক্ষ্য, তার চেয়ে বৃহত্তর লক্ষ্য ছাত্র রাজনীতি থেকে যেন বুয়েটের শিক্ষার্থীরা বিযুক্ত না থাকে।”
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন, সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতসহ বিভিন্ন ইউনিটের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।